পারভীন লুনা, বগুড়া:
ঘরে বসে থাকতে তার ভালো লাগতো না। ঘরে মন বসে না, মায়ের হাতের সেলাই এর সুঁই কেড়ে নিয়ে নিজেই সেলাই করতো, খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছিল নুসরাত। মায়ের হাতের কাজ গুলি কেড়ে নিয়ে করাতে মায়ের খুব বকাঝকা খেতো নুসরাত। খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তার অনেক স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি, তারপরেও তিনি হাল ছাড়েননি। ইসরাতের স্বপ্ন পূরণের প্রথম শুরু ছিল রান্না থেকে। রান্নার উপর দুর্বলতা থেকে তিনি সুকন্যা পেস্ট্রি শপ নামে একটি বেকারি পরিচালনা করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’ নিজের বাচ্চাদের স্কুলের টিফিন নিজে বানিয়ে দিতেন, বাচ্চাদের এই টিফিন নেওয়া দেখে সবার মন কেড়ে নেন।অন্য বাচ্চারা মায়ের কাছে আবদার করতো তার বাচ্চাদের মতো টিফিন খাবে। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতেন আর সাথে নিয়ে যেতেন নিজের তৈরি বিভিন্ন ধরনের আচার, বিস্কিট, কেক, পুডিং। সেখান থেকেই তার রান্নার সুনাম ছড়িয়ে পরে। অনেক মহিলারা তার কাছ থেকে রান্না শিখতে চায়।তারপর তিনি ২০০২ সাল থেকে রান্নার ট্রেনিং করানো শুরু করেন।
ইসরাত জাহান বলেন, ‘বগুড়ায় রান্নাবিষয়ক কর্মশালা আয়োজনের পাশাপাশি ব্লকপ্রিন্ট, বাটিক, টেইলারিংসহ পোশাকে সুই-সুতার শৈল্পিক কারুকাজেও ঝুঁকে পড়ি। একসময় নিজেই দেশি-বিদেশি রান্নার প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। নানা রকমের কেক বানিয়ে বিক্রি করতাম। আয় থেকে সঞ্চয় করতে থাকি। বউ সাজানোর শখ থেকে শহরের কাটনারপাড়া এলাকায় ছোট পরিসরে বিউটি পার্লার দেই। তখন শহরে বিউটি পার্লার ছিল হাতে গোনা দুয়েকটি। ঝুঁকি নিয়ে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করি।
ইসরাত এখন বগুড়া শহরের প্রতিষ্ঠিত একটি ফ্যাশন হাউজের উদ্যোক্তাও। অনেকটা শূন্য থেকেই আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। কয়েক কোটি টাকার পুঁজি খাটছে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সুকন্যা ফ্যাশনে। বগুড়া শহরের অভিজাত এলাকা জলেশ্বরীতলায় সুকন্যা বিউটি অ্যান্ড স্পা এবং সুকন্যা জেন্টস ব্লু সেলুন অ্যান্ড স্পা চালু করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন প্রায় ১৫০ জন কর্মী।
এখন বগুড়া শহরে এক নামেই পরিচিত সুকন্যা বিউটি পার্লার। গত সেপ্টেম্বর মাসে এই পার্লারে প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছে আয়ুর্বেদিক ট্রিটমেন্ট। ইসরাত জাহান বলেন, ‘শুধু নিজের ব্যবসাই দাঁড় করাইনি, বরং অন্য নারীদের দক্ষ করে তুলতেও কাজ করছি। ২০১৯ সালে বগুড়া শহরে চালু করেছি সৌন্দর্যচর্চা প্রশিক্ষণকেন্দ্র। আছে সুকন্যা স্কিল ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং সেন্টার। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত এই রূপচর্চা প্রশিক্ষণ স্কুলটির কার্যক্রম বর্তমানে করোনার সংক্রমণের কারণে বন্ধ।’ সফল ইসরাত জাহান অন্য নারীদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। অনেকেই তাঁকে দেখে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস পাচ্ছেন। ইসরাত জাহান বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য। মেকআপ, ত্বকের যত্ন, অ্যারোমা থেরাপি, হেয়ার কাটসহ নানা বিষয়ে ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে রান্নার হাতও যে ঠিকমতো পাকিয়েছেন, সেটা বোঝা যায় ২০০৫ সালে প্রাণ-প্রথম আলো জাতীয় আচার প্রতিযোগিতায় (মিষ্টি বিভাগ) দ্বিতীয় পুরস্কারের মাধ্যমে। এ ছাড়া রূপচাঁদা রান্না প্রতিযোগিতায় ২০১৬ সালে আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম রানারআপ হয়েছিলেন ইসরাত জাহান।
ইসরাত প্রশিক্ষক হিসেবে অনেক সুনাম অর্জন করেছেন।
ইসরাত জাহানের স্কুলে লেভেল-১ ও ২ নামে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালু আছে। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি কোর্স আছে ব্লক, বাটিক, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ইত্যাদি। জানা যায়, প্রায় দের বছরের কাছাকাছি করোনাকালে বিয়েসহ সবধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় পারলারের ব্যবসা প্রচণ্ড রকমের ধাক্কার মুখে পড়েছে। দীর্ঘ সময় পারলার বন্ধ থাকায় কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে পার্লার ব্যবসা পুরোপুরি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তবে চেষ্টা চলছে। তার পার্লারের সঙ্গে শত শত কর্মীর জীবিকা জড়িয়ে আছে। ইসরাত তাই মনে করেন, এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা বা স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
ইসরাত জাহান জানালেন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার দীর্ঘ পথ পাড়ির এই সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন স্বামীর কাছ থেকে। কোনো উদ্যোগেই তিনি বাধা হয়ে দাঁড়াননি, বরং সব সময় তিনি বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়েছেন, যা এখনো তাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। ব্যবসার আয়ে সন্তানেরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে ইসরাতের। দুজনেই এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বগুড়া লেডিস ক্লাব ও ইনার হুইল ক্লাবের সদস্য হয়ে সামাজিক কার্যক্রমেও যুক্ত ইসরাত জাহান।
ইসরাতের মতে, ব্যবসা মানেই হার,জিতের খেলা। করোনার সংকট সেটা আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। তবু থেমে গেলে চলবে না। নারীদের সাহস করে ঝুঁকি নিয়েই সফল হতে হবে।অচিরেই চালু হবে আরেকটি নতুন উদ্যোগ—রেস্তোরাঁ।
ইসরাত নতুন চমক নিয়ে আসছেন বগুড়া বাসির জন্য।বগুড়া শহরে একটি রেস্তোরাঁ করার ইচ্ছা ইসরাত জাহানের অনেক দিনের। সেই লক্ষ্যেই সবকিছু ঠিকঠাক। এখন শুধু ফিতা কেটে উনুনে আগুন দেওয়ার অপেক্ষা। ইসরাত বলেন আমার রেস্টুরেন্টের কিচেন হবে লাইভ।করোনা মহামারি না এলে দুই বছর আগেই রেস্তোরাঁ চালু করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেটা কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। নতুন রেস্তরোঁর বিশেষত্ব কী—এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরাত জাহান বলেন, ‘আমার রেস্তোরাঁয় ফিউশন ফুড থাকবে। একই সঙ্গে ক্যাটারিং করার ইচ্ছা আছে। ভোজনরসিকরা এসে খাবারের অর্ডার করবে আর খাবারটি তখনি তাদের সামনেই তৈরি হবে।
বেকারি ও ফাস্টফুডের খাবারকেও গুরুত্ব দিয়ে রাখা হবে। এ ছাড়া নতুন কিছু আইটেম থাকবে। আমার পরিচিত জনরা সব সময় চায়, আমি খাবারের একটা রেস্তোরাঁ করি। এবার তাদের সে আশা পূরণ হবে।
যারা নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে ইসরাত জাহান বলেন, সবার আগে কাজটার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আর এখন নতুনদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ আছে। এসএমই ঋণসুবিধা রয়েছে। এ ঋণ পেতে কোনো জামানত দেওয়ার দরকার হয় না। আর সুদহারও তুলনামূলক কম। চাইলে নারীরা এ ঋণসুবিধা গ্রহণ করে কাজ শুরু করতে পারে।
ইসরাত জাহানের বলেন, ‘সবার ওপরে আমার কাছে দেশ। আমি যা–ই করি না কেন, দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার পোশাকে কাজগুলোতে সব সময় দেশি মোটিফ থাকে। ঠিক আমার খাবারের রেস্তোরাঁতেও দেশিও ছোয়া প্রাধান্য পাবে। আমি উদ্যোক্তা তৈরি করতে পছন্দ করি। গরিব মেয়েদের উৎসাহ দিই। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। দেশি পণ্য তৈরি করার জন্য সহযোগিতা করি। দেশ ও বিদেশে অনেকেই কাজ করছে, যাদের শুরুটা আমার এখান থেকে।